বায়োমেট্রিক শব্দটির সাথে আমরা সিম রেজিস্ট্রেশন এর জন্য খুবই পরিচিত হয়েছি। কারন, আমাদের দেশের সকলেই এই পদ্ধতিতে সিম রেজিস্ট্রেশন করে ব্যবহার করেন। সেজন্য হয়তো অনেকে বায়োমেট্রিক অর্থ সিম রেজিস্ট্রেশন এর পদ্ধতিও ভাবতে পারেন। আসলে ব্যাপারটা তেমন নয়। বায়োমেট্রিক হচ্ছে এক ধরনের বিশেষ প্রযুক্তি।
আমরা আজকের পর্বে বায়োমেট্রিক কী? বায়োমেট্রিক কীভাবে কাজ করে? এর ইতিহাস এবং বায়োমেট্রিক এর সুবিধা-অসুবিধা সম্পর্কে জানব। আসুন, দেরি না করে শুরু করি।
বায়োমেট্রিক পদ্ধতি কী?
বায়োমেট্রিক হচ্ছে এমন এক প্রযুক্তি, যার মাধ্যমে প্রত্যেককে আলাদাভাবে শনাক্ত করা যায়। শব্দ বিশ্লেষণ করলে আমরা জানতে পারি যে, Bio অর্থ ‘জীবন’ এবং মেট্রিক্স শব্দটি গ্রীক শব্দ Metron থেকে এসেছে, যার অর্থ পরিমাপ।
অর্থাৎ বায়োমেট্রিক শব্দটি দিয়ে আমাদের সবার যে ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্য আছে, তা পরিমাপের কথা বলা হয়েছে। তাই আমরা বলতে পারি যে, বায়োমেট্রিক প্রযুক্তি হচ্ছে যেকোনো মানবের শারিরিক গঠন, বৈশিষ্ট্য, আচার-আচরণ, গুণাবলী, ব্যাক্তিত্ব, স্বাক্ষর ইত্যাদি দ্বারা নির্দিষ্ট কোনো ব্যাক্তিকে আলাদাভাবে শনাক্ত করা।
বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে ব্যবহৃত বায়োলজিক্যাল ডাটা
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, বায়োমেট্রিক এ মানব শরীরের কোন কোন বায়োলজিক্যাল ডাটা ব্যবহৃত হয়?
আমাদের হাতের আঙুল, হাতের পরিমাপ, মুখমণ্ডল, চোখের আইরিশ ও রেটিনা, দাঁতের বিন্যাস, হাতের শিরা বা রগ, কন্ঠস্বর, স্বাক্ষর, চুল-নখ-জিহবার লালার ডিএনএ ইত্যাদির মাধ্যমে আমাদেরকে বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে শনাক্ত করা যায়। আর আমাদের প্রত্যেকেরই এসব বায়োলজিক্যাল ডাটা আলাদা আলাদা হয়ে থাকে।
বায়োমেট্রিক এর ইতিহাস
বায়োমেট্রিক পদ্ধতি সম্পর্কে ১৯ শতাব্দীর আগে ২ জন বিজ্ঞানী সর্বপ্রথম পরিকল্পনা করেছিলেন। তারপর ১৮৯১ সালে আর্জেন্টিনার Juan Vucetich নামের একজন বিজ্ঞানী আঙুলের ছাপ ধরে রাখার মতো একটি যন্ত্র আবিষ্কার করেন এবং এটি তাদের সামরিক বাহিনীর কাছে যন্ত্রটি হস্তান্তর করেন।
মূলত এই আবিষ্কারটি ছিল তৎকালীন সন্ত্রাসীদের আঙুলের ছাপ রেকর্ড করে রাখার জন্য বিশেষ যন্ত্র। অর্থাৎ তখন থেকেই বায়োমেট্রিক পদ্ধতির সূচনা হয়েছে। তবে বায়োমেট্রিক্স এর জনক Margaret Oakley Deyhaff কে বলা হয়ে থাকে।
বায়োমেট্রিক কত প্রকার ও কী কী?
বায়োমেট্রিক শনাক্ত করার পদ্ধতি সাধারনত ২ প্রকার।
- (১) মানবদেহের গঠন ও শারীরিক বৈশিষ্ট্যের উপর বায়োমেট্রিক পদ্ধতি
- (২) মানবহদেহের আচরণগত বৈশিষ্ট্যের উপর বায়োমেট্রিক পদ্ধতি। আসুন এবার এই দুটি একটু বিশ্লেষণ করা যাক।
মানবদেহের গঠন ও শারীরিক বৈশিষ্ট্যের শনাক্তের পদ্ধতি
১. হাতের ফিঙ্গারপ্রিন্টঃ
এটি সবচেয়ে গ্রহনযোগ্য পদ্ধতি, কারণ আমাদের প্রত্যেকের আঙুলের ছাপ একদমই আলাদা। আর এটি পরিমাপ করা সহজ। সিম কিনতে গেলে এটি ব্যবহার হয়। তাই আমরা এই পদ্ধতি সম্পর্কে সবাই জানি।
২. মুখমন্ডলঃ
আমাদের সবার চেহারাই আলাদা। তাই এটির মাধ্যমেও বায়োমেট্রিক করা হয়। তবে এটি তেমন গ্রহণযোগ্য না।
৩. চোখের আইরিশঃ
এই পদ্ধতিতে আমাদের চোখের মণির চারপাশের রঙিন রিং কে পরিমাপ ও বিশ্লেষণ করা হয়।
৪. চোখের রেটিনাঃ
এখানে চোখের রেটিনার পরিমাপ এনালাইসিস করা হয়।
৫. হাতের শিরা বা রগঃ
আমাদের হাতের কব্জির রগের নমুনাও বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে বিশ্লেষণ করা হয়।
আচরণগত বৈশিষ্ট্যের বায়োমেটিক শনাক্তকরণ-
১. স্বাক্ষরঃ
আমাদের সবারই হাতের লিখা একদম আলাদা। তাই এই পদ্ধতিতে হাতের লিখা বিশ্লেষণ একদমই সহজ।
২. গলার স্বরঃ
আমাদের সবারই গলার আওয়াজ, গানের সুর, কথা বলার স্টাইল আলাদা। এভাবেও বায়োমেট্রিক শনাক্ত করা হয়।
বায়োমেট্রিক শনাক্তের যন্ত্রপাতি কী কী?
সাধারনত ২ ভাবে বায়োমেট্রিক যন্ত্র শনাক্তের কাজে ব্যবহার হয়।
১. বিযুক্ত ডিভাইস-
এখানে বায়োমেট্রিক ডিভাইসের জন্য আলাদা হোস্ট ডিভাইসের প্রয়োজন হয়। যেমন- ফিঙ্গারপ্রিন্ট/আইরিশ শনাক্তের জন্য সেসব ডিভাইসের সাথে কম্পিউটার, মোবাইল বা Micro-ATM ইত্যাদির সংযোগ প্রয়োজন হয়।
২. ইন্টিগ্রেটেড ডিভাইস-
এখানে ডিভাইসের সাথেই বিভিন্ন সেন্সর সমন্বিত থাকে। আলাদাভাবে কোনো যন্ত্রের প্রয়োজন হয়না।
বায়োমেট্রিক পদ্ধতি কীভাবে কাজ করে?
আগেই জেনেছি আমাদের দেহের কিছু জিনিস, অন্যদের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। বায়োমেট্রিক পদ্ধতি আমাদের শরীরের নমুনা নিয়ে ২ ভাবে কাজ করে।
- ১ম ধাপ – আমাদের আঙুলের ছাপ বা দেহের অন্যান্য নমুনা বা DNA এর নমুনা নেওয়া হয়।
- ২য় ধাপ- সংরক্ষন করা নমুনা আমাদের নাম-ঠিকানা-পদবী নামে ডাটাবেজ এ রাখা হয়।
অতএব আমরা যদি পরবর্তীতে আমাদের নাম-ঠিকানা-পদবী বদলে ফেলি, তাহলে তাদের ডাটাবেজের আমাদেরকে চিহ্নিত করা সম্ভব হবে।
উদাহরণ – সিম রেজিষ্ট্রেশন। একজন ব্যক্তি ১৫টির বেশি সিম নিতে পারবে না। এবং সিম হারিয়ে গেলে, নির্দিষ্ট ব্যাক্তির আঙুলের ছাপ ছাড়া তা তোলা যাবেনা।
বায়োমেট্রিক এর ব্যবহার কোথায় হয়?
- যেকোনো দেশে যেতে ইমিগ্রেশনে ব্যবহার করা হয়।
- এনআইডি ও পাসপোর্ট তৈরিতে ব্যবহার করা হয়।
- আমার/আপনার মোবাইলের ফিঙ্গারপ্রিন্ট লক খুলার জন্য ব্যবহৃত হয়।
- সামরিক বাহিনী নিরাপত্তামূলক কাজে এটি ব্যবহৃত করে।
- আজকাল যানবাহন নিরাপত্তায়ও এটি ব্যবহার হচ্ছে।
বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে কীভাবে সিম নিবন্ধন হয়?
পাকিস্তান বিশ্বের ১ম দেশ হিসেবে বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে সিম নিবন্ধন চালু করে। আর বাংলাদেশ পাকিস্তানের পর ২য় দেশ হিসেবে বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে সিম নিবন্ধন শুরু করে। যেকোনো কোপানির মোবাইল সিম নিবন্ধনের জন্য প্রয়োজন ১টি ট্যাব/মোবাইল/পিসি এবং ১টি ফিঙ্গারপ্রিন্ট রিডার ডিভাইস।
২টি ডিভাইসকে সংযুক্ত করে সিম ক্রয়কারীর আঙুলের ছাপ ও এনআইডি তথ্য নেওয়া হয়। সিম কোম্পানি পরবর্তীতে এই ছাপের মাধ্যমেই ব্যবহারকারীকে অনুসন্ধান বা প্রয়োজনীয় সেবা দিতে সক্ষম। কেননা, আঙুলের ছাপের মধ্যে পাসপোর্ট বা এনআইডি তথ্য থাকে।
বায়োমেট্রিক পদ্ধতির সুবিধাসমূহ
বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে সন্ত্রাসীদের সহজেই শনাক্ত করা যায়। এছাড়াও হারিয়ে যাওয়া বা অমীমাংসিত সন্তানের মামলা এই পদ্ধতিতেই নিস্পত্তি করা হয়। পাশাপাশি যেকোনো ডিভাইসের মধ্যে নিরাপত্তার জন্য এটি বেশ কাজে দেয়।
বায়োমেট্রিক পদ্ধতির অসুবিধাসমূহ
এই পদ্ধতিটি মূলত সন্ত্রাসীদের জন্যই আবির্ভাব হয়েছে। কিন্তু হচ্ছে তার উল্টোটা, কারণ এভাবে সন্ত্রাসীদের শনাক্ত বা নিয়ন্ত্রণ করা পুরোপুরি সম্ভব না। এছাড়াও এতে করে আমাদের মত সাধারণ মানুষদের তথ্য নিরাপত্তার ঝুঁকি থাকে।
শেষকথা
বায়োমেট্রিক নিয়ে আপনার মতামত কী? আমাদের কমেন্ট করে জানান। দেখা হবে পরবর্তী পর্বে, কোনো নতুন প্রযুক্তি নিয়ে। আল্লাহ হাফেজ।